Home » মালিতে বৈরী পরিবেশে সাফল্যের সাথে কাজ করছে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা – নূর ইসলাম হাবিব, সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর

মালিতে বৈরী পরিবেশে সাফল্যের সাথে কাজ করছে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা – নূর ইসলাম হাবিব, সহকারী পরিচালক, আইএসপিআর

Author: আইএসপিআর

পশ্চিম আফ্রিকার দেশ  মালি। এর রাজধানী বামাকো। এটি সেদেশের সবচেয়ে বড় শহর। স’ল বেষ্টিত। সরকারী ভষা ফরাসী ও বামবারা। ফ্রান্সের নিকট থেকে মালি স্বাধীনতা লাভ করে ১৯৬০ সালের ২০ জুলাই। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম বোওবাকার কিয়েতা। প্রধানমন্ত্রী মদিবো কিয়েতা। মালির আয়তন ৪ লাখ ৭৮ হাজার ৮৩৯ বঃ মাঃ। লোকসংখ্যা ১ কোটি ৪৫ লক্ষ ১৭ হাজার ১৭৬ জন। শতকরা ৯০% এর বেশী লোক বাস করে মালির দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে বামাকোতে। বামাকোর লোকসংখ্যা ১০ লাখের উপরে। মালির  মুদ্রার নাম সেফা। এক ডলারের মূল্যমান ৬০০ সেফার সমান।

যানবাহন ডান দিকে চালিত। মালির উত্তরে মধ্য সাহারা, দক্ষিণ অংশে রয়েছে নাইজার এবং সেনেগাল নদী। প্রধান পেশা কৃষি ও মৎস চাষ। প্রধান খনিজ পদার্থ স্বর্ণ। মালি আফ্রিকায় স্বর্ণ উৎপাদনে তৃতীয় Ñদক্ষিণ আফ্রিকা ও ঘানার পরে মালির অবস্থান। তাছাড়া আছে লবন। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী দারিদ্র সীমার নীচে বসবাস করে।

বর্তমান মালি ছিল পশ্চিম আফ্রিকা সা¤্রাজ্যের অংশ যা ট্রান্স সাহারান বানিজ্য নিয়ন্ত্রণ করত। মালির স্বর্নযুগে এখানে গনিত, জ্যোতির্বিদ্যা, সাহিত্য ও চিত্রকলার বিকাশ ঘটেছিল। ১৩শ শতকে মালি ছিল বর্তমান ফ্রান্সের দ্বিগুণ এবং আটলান্টিকের পশ্চিম উপকুল পর্যন্ত বিস্তৃত। ১৯ শতকের শেষ দিকে মালির নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ফ্রান্সের হাতে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ দিন একদলীয় শাসন চলার পর ১৯৯১ সালে সামরিক অভ্যূত্থান হয়। এর পর রচিত হয় দেশের সংবিধান। দেশে ফিরে আসে বহুদলীয় গণতন্ত্র।

২০১২ সালের জানুযারি মাসে মালির উত্তরাংশে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। এ সময় তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা উত্তরাংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং আজওয়াদ ল্যান্ড হিসাবে পৃথক রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয়। মার্চে সামরিক অভ্যূত্থান এবং তুয়ারেগ ও ইসলামপন্থী বিদ্রোহীদের মধ্যে সংঘর্ষ অবস্থার আরো অবনতি ঘটায়।

ফ্রান্স ২০১৩ সালের মালিতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে । এক মাসের মধ্যে ফ্রান্স এবং মালির সেনাবাহিনী যৌথ অভিযান চালায় এবং দেশের উত্তরাঞ্চলে অধিকাংশের নিয়ন্ত্রণ বিদ্রোহীদের নিকট থেকে পুনরায় নিয়ে নেয়।

২০১৩ সালের ২৮ জুলাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় একই বছর ২৪ নভেম্বর ও ১৫ ডিসেম্বর।

মালির সশস্ত্র বাহিনী সেনা ও বিমান বাহিনী নিয়ে গঠিত । তাছাড়া আছে আধা সামরিক বাহিনী জেন্ডারমেরী, পুলিশ ও রিপাবলিকান গার্ড। সেনাসদস্যদের বেতন ও সুযোগ সুবিধা খুবই কম এবং অস্ত্রশস্ত্র সীমিত।

মালির ৬৮% অধিবাসী গ্রামে বাস করে।  মালিতে জন্ম হার ১০০০ জনে ৪৫.৫৩ জন। প্রত্যেক বিবাহিত নারীর গড় সন্তান সংখ্যা ৬.৫ জন। মৃত্যু হার ১৬.৫ প্রতি হাজারে। গড় আয়ু ৫৩.০৬ বছর । শিশু মৃত্যুর হার অত্যধিক। হাজারে ১০৬ জন। মালির ৮০% লোক বামবারা ভাষায় কথা বলে। এটা লিংগুয়া ফ্রাংকা হিসাবে কাজ করে। মালিতে এক সময় ব্যাপকভাবে দাশ প্রথা চালু ছিল। মালির প্রায় ৮ লাখ লোক দাস বংশজাত। বর্তমান সময়েও প্রায় ২ লাখ লোক দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে এখনো মুক্তি পায়নি।

উত্তরের তুয়ারেগ জনসংখ্যার সাথে মালি সরকারের সংঘর্ষ চলছে। তুয়ারেগ ও কট্টর ইসলামপন্থী যারা শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের মধ্যেও সংর্ঘষ চলছে।

মালিতে দ্বাদশ শতকে ইসলাম ধর্মের আগমন ঘটে। ওখানকার প্রায় ৯০% লোক মুসলিম (সুন্নী ও আহমদিয়া), প্রায় ৫% আদিম ধর্মালম্বী। সংবিধান ধর্ম নিরপেক্ষ। এখানে সকল ধর্মের ধর্ম পালনের সমান অধিকার রয়েছে। শিক্ষিতের হার ২৭%-৪৬%। বড় বিশ¡বিদ্যালয় বামাকো বিশ¡বিদ্যালয়। এ দেশে নারী শিক্ষার হার খুবই কম।

মালি সংঘর্ষ ঃ

২০১২ সালের জানুয়ারী মাস থেকে উত্তর মালির কয়েকটি বিদ্রোহী গ্রুপ আজওয়াদ ল্যান্ড প্রতিষ্ঠা অথবা অধিকতর সায়ত্ত্বশাসনের দাবীতে মালি সরকারের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। National Movenment for Liberation of Azwad (MNLA) তুয়ারেগ জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাধীন আবাসভূমি আজওয়াদ ল্যান্ডের দাবীতে মালি সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়। ২০১২ সালের এপ্রিল মাসের মধ্যে তারা উত্তরাঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। মালি সংকটের সমাধানে ব্যর্থতার অভিযোগে ২০১২ সালের ২২ মার্চ সামরিক অভ্যূত্থানে প্রেসিডেন্ট আমাদো তোমানী তুরে ক্ষমতাচ্যুত হন। চার মাস পরে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ছিল। সামরিক সরকার সংবিধান স’গিত করে। সেনা অভ্যূত্থানের পর অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ফলে কিদাল, গ্ওা এবং তিমবুকতু বিদ্রোহীদের দখলে চলে যায় এবং ৬ এপ্রিলMNLA মালি থেকে আজওয়াদ ল্যান্ড পৃথক করে একে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা দেয়। প্রথম দিকে ‘আনসার দিনে’ নামক ইসলামী সংগঠন MNLA কে সমর্থন করত। পরে তারা অন্য কয়েকটি ছোট ছোট ইসলামী সংগঠন একত্রিত হয়ে আজওয়াদ ল্যান্ডে ইসলামী শরীয়া আইন বাস্তবায়নের চেষ্টা করে। এর ফলে গঘখঅ এর সাথে তাদের বিরোধ দেখা দেয় এবং  MNLA তাদের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১৭ জুলাইয়ের মধ্যে (২০১২) MNLA উত্তর মালির অধিকাংশ শহরের নিয়ন্ত্রণ হারায় এবং নিয়ন্ত্রণ চলে যায় ইসলামী গ্রুপগুলোর হাতে।

উত্তরাঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মালিয়ান সরকার বিদেশী সামরিক সহায়তার অনুরোধ জানায়। ২০১৩  সালের ১১ জানুয়ারী ফ্রান্স এর সামরিক বাহিনী মালিতে ইসলামী বিদ্রোহী গ্রুপের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। অন্যান্য আফ্রিকান দেশ থেকেও মালিতে সেনাবাহিনী পাঠানো হয়।  আন্তর্জাতিক বাহিনীর সহায়তায় ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে (২০১৩) মালিয়ান সরকার উত্তরাঞ্চলের দখল নিয়ে নেয়। তবে বিদ্রোহীদের আক্রমণ তখনও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। সরকার এবং তুয়ারেগ বিদ্রোহীদের মধ্যে ১৮ জুন ২০১৩ তারিখে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু ২৬ সেপ্টেম্বর তুয়ারেগ বিদ্রোহীরা শান্তি চুক্তি প্রত্যাখান করে এবং অভিযোগ করে যে, সরকার শান্তিচুক্তির শর্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়। এখনো সংঘর্ষ অব্যাহত রয়েছে। ২০১৫ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি আলজেরিয়ার আলজিয়ার্সে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স¦াক্ষরিত হয়। তারপরেও বিদ্রোহীদের বিক্ষিপ্ত হামলা অব্যাহত রয়েছে। মালি সরকারের অনুরোধের প্রেক্ষিতে জাতিসংঘ ২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর মালিতে বহু জাতিক বাহিনী প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা  মিশনের নাম united nations multidimentional integrated stabilization mission in mali—MINUSMA)

বর্তমানে কোন বড় শহরের নিয়ন্ত্রণ নেই MNLA এর হাতে। তারা এখন শুধু গ্রামাঞ্চলে এবং মরু অঞ্চলে শক্তিশালী অবস্থান ধরে রেখেছে। বিশেষ করে মৌরিতানিয়া, আলজেরিয়া এবং নাইজারের সীমান্তবর্তী এলাকায়।

মালিতে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী ঃ কার্যক্রম পরিদর্শনে শুভেচ্ছা দল ঃ

মালিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম দল আসে ২০১৪ সালের ১ এপ্রিল। ২৫ এপ্রিল আসে মুল দল। মালিতে ১০টি দেশের শান্তিরক্ষীরা কাজ করেছে। এগুলো হলো- বাংলাদেশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, চীন, নেদারল্যান্ড, নাইজার, আইভরিকোষ্ট, সেনেগাল, চাঁদ ও বরকিনা ফসো।।

মালিতে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী সংখ্যা ১৭২২ জন ( মে ২০১৫)। এর মধ্যে সেনাবাহিনী ১৩১০ জন, নৌবাহিনী ১৩৩ জন, বিমান বাহিনী ১২৩ জন, পুলিশ সদস্য ১৪০ জন এবং স্টাফ অফিসার ১৬ জন।

মালিতে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম সরেজমিনে পরিদর্শণের জন্য ১৩ সদস্যের একটি শুভেচ্ছা দল গত ৫ মে ২০১৫ মালি সফরে গমন করে। এ দলের প্রধান ছিলেন ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং  মেজর জেনারেল মোঃ সালাহ উদ্দিন মিয়াজী, পিএসসি ( বর্তমানে উপাচার্য, বিইউপি )। অন্য সদস্যরা হলেন-বিপসট-এর লেঃ কর্নেল  মোঃ জাকির হোসেন ভূঞা, পিএসসি, সামরিক সচিব শাখার লেঃ কর্নেল মোঃ মোতাহার হোসেন, এমআই পরিদপ্তরের লে. তর্নেল মো: জাহেদুর  রহমান, ওভারসীজ পরিদপ্তরের মেজর মোহাম্মদ ফিরোজ আহমেদ, পিএসসি, ডিজিএফআই এর মেজর মুনতাসির রহমান চৌধুরী, অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব কাজী মাহবুব হাসান, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোঃ সফিকুল আহম্মদ, ডিফেন্স ফাইনান্স-এর জেসিজিডিএফ (তৎকালীন) মোঃ খুরশীদ আলম পাটওয়ারী, আইএসপিআর থেকে আমি মোঃ নূর ইসলাম, দেশ টিভির স্টাফ রির্পোটার আপেল মাহমুদ এবং ক্যামেরাম্যান মহিউদ্দিন শিবলী ও ওভারসীজ পরিদপ্তরের সার্জেন্ট মোঃ মনিরুল ইসলাম। আমরা একই সাথে মালি এবং মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র ভ্রমণ করি। প্রথমে মালি এবং পরে মধ্য আফ্রিকা।

৫ মে রাত একটায় হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আমাদের রিপোর্ট করার কথা। আমি কিছুটা আগেই সেখানে চলে যাই। তখন রাত ১২টা। আমি অপেক্ষা করতে থাকি। এরপর একে একে সবাই এসে হাজির হন। ইমিগ্রেসনের কাজ কর্ম সেরে আমরা প্রস্তুত বিমানে ওঠার জন্য। আমরা যাচ্ছি কাতার এয়ারওয়েজে। ৩টা ২৫ মিনিটে আমাদের বিমান ছাড়লো। বিমান ছাড়ার কিছুক্ষণের মধ্যে এয়ার হোস্টেজ আমাদের খাবার দিয়ে যায়। কিন্তু কিভারে খাব? রাত সাড়ে তিনটা চারটা তো খাবার সময় নয়। ঘুমও আসছেনা তেমন। এভাবে চলার পর আকাশ পরিস্কার হয়ে আসে। পারস্য উপসাগরে নৌচলাচল চোখে পড়ে। কিছুক্ষণ পরেই আমরা পৌছলাম দোহা এয়ারপোর্টে। বিশাল বড় এয়ারপোর্ট। তখন স্থানীয় সময় ৫টা ৩০ মিনিট। বাংলাদেশ সময় ৮টা ৩০ মিনিট। ৫ ঘন্টার জার্নি। পরবর্তী ফ্লাইট ৯টা ২০ মিনিটে। প্রায় ৪ ঘন্টা ট্রান্সিট সময় পেলাম। আমরা দোহা এয়ারপোর্ট ঘুরে ঘুরে দেখছি আর ছবি তুলছি, সঙ্গী দেশ টিভির আপেল মাহমুদ। একটি দোকানের সামনে দাঁড়ালাম। তরুণী দোকানীকে দেখে মনে হলো কোরিয়ান। জিজ্ঞেস করতে বলল-চীন। বললাম মাও সেতুং-এর দেশ। তরুনী কোন কথা বলছেনা। তারপর বলল, মাওসেতুং-এর নাম সে জানেনা। তারপর বললাম মাওজেদং। তাও সে চেনেনা। অবাক কান্ড চীনের নাগরিক অথচ মাওসেতুংকে সে চেনে না। আমরা বললাম আমাদের দেশ বাংলাদেশ। ও জিজ্ঞেস করল এটা কি চীনের কাছের কোন দেশ কিনা। বললাম-না। ভারতের কাছের একটি দেশ। বললাম, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশ। শেখ মুজিবের নামও সে শোনেনি। যে মাওসেতুং-এর নাম জানেনা সে কি করে শেখ মুজিবের নাম জানবে !

৯টা ২০ মিনিটে আমাদের বিমান আকাশে উড়ল দোহা বিমান বন্দর থেকে। এবারও কাতার এয়ার ওয়েজ। আমরা যাচ্ছি মরক্কোর বন্দর নগরী ক্যাসাব্লাংকায়। আটলান্টিকের তীরবর্তী সেদেশের বন্দর নগরী ক্যাসাব্লাংকায় । আমি ও দেশ টিভির আপেল মাহমুদ পাশাপাশি সীটে বসেছি। ক্যামেরাম্যান শিবলী একটু দূরে । এয়ার হোস্টেজদের একজনের বাঙালির মত চেহারা। হয়তো ভারতীয় হবে। জিজ্ঞেস করতে বলল, হ্যাঁ আমি ভারতীয়। কোন রাজ্য জানতে চাইলে রাজ্যের নাম না বলে বলল কলকাতা। অর্থাৎ কলকাতার মেয়ে-নাম পদ্মা। এ সময় শিবলী সেলফি তুলছিল। পদ্মা মনে করছে তার ছবি তুলছে। শিবলীর কাছে তাই তার প্রশ্নÑÑ“পিকচার অব আস, পিকচার অব আস?” অর্থাৎ তার ছবি তোলা হয়েছে কিনা। শিবলী বলছে, না আপনার ছবি নয় আমি সেলফি তুলেছি। কিন্তু পদ্মার সন্দেহ কাটেনি। শেষ পর্যন্ত সে ছবিগুলো দেখতে চাইল। তাকে ছবিগুলো দেখানো হলো। তখন নিশ্চিত হলো তার ছবি তোলা হয়নি। আমরা ক্যাসাব্লাংকায় পৌছলাম বেলা ৩টায়। পরবর্তী ফ্লাইট রাত ৯টায়। বিমানবন্দরে নেমে আমাদের একসদস্য বিমানবন্দর কর্মীকে জিজ্ঞাস করে আমাদের লাগেজ কোথায়? বিমান বন্দর কর্মীর উওর “দন্তুরী এবাউথ ইওর লাগেজ ” ( ও যেভাবে উচ্চারণ করেছে  সেভাবেই তুলে ধরা হলো। আসলে হবে-Don’t worry about your luggage)। তোমাদের লাগেজের জন্য চিন্তা করনা।

আমরা বিমানবন্দরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত ঘুরছি, ছবি তুলছি। আবার কখনো বসে সময় কাটাচ্ছি। শেষ বিকেলে প্রচন্ড ক্ষুধা লাগল। রেস্তোরায় গেলাম। একটি পেটিসের দাম চাইল দুই মার্কিন ডলার। মানে ১৬০ টাকা। দোকানীকে দিতে বললাম। আমার কাছে ১০০ ডলারের নোট। দোকানী তরুনী বলল, ভাংতি হবে না। না কিনেই ফিরে এলাম প্যাসেঞ্চার লাউঞ্জে। খুরশীদ আলম ভাই এ সময় বের করল এনার্জি বিস্কুট। খেয়ে কিছুটা ক্ষুধা থামল। মরক্কোর সরকারী ভাষা আরবী ও ফরাসী। বিমান বন্দরে বসে আছি। ৮টা ১৫ মিনিট ঘড়িতে দেখাচ্ছে। কিন্তু সূর্য ডুবছেনা, বিস্মিত হলাম। পরে জানলাম, এদেশের সময় ১ ঘন্টা এগিয়ে আনা হয়েছে। অর্থাৎ লাইট সেভিং ডিজিটাল সময়।

এবার যাচ্ছি রয়্যাল মরক্কো এয়ারে, মালির রাজধানী বামাকোর উদ্দেশে। আমাদের বিমান যাচ্ছে ৩৮ হাজার ফুট উপর দিয়ে। বাইরের তাপমাত্রা মাইনাস ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। রাত ৩টায় আমরা বামাকো বিমানবন্দরে পৌছাই। সেখানে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান সেদেশের সংসদ সদস্য এবং অর্থ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মামাদু এনফা সিমপারা। বিমানবন্দর পার হয়ে বাইরে আসতে শোনা গেল পরিচিত শব্দ কমলা, কমলা। মালিয়ানদের মুখে বাংলা শব্দ। ওরা ফেরি করছে অরেঞ্জ ব্রান্ডের মোবাইল সীম। আমাদের দেখে ঠিকই বুঝে ফেলেছে আমরা বাংলাদেশী। বামাকোর তাপমাত্রা অনেকটা আমাদের দেশের মত। তখন তাপমাত্রা ছিল ৩০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

এমপি সিমপারা আমাদের পেয়ে খুবই খুশী। বিশেষ করে একজন জেনারেলকে পেয়ে তিনি আবেগাপ্লুত। এ আন্তরিকতার সাথে এই ভোর রাতে তিনি আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে বিমানবন্দরে এসেছেন। তিনি মেজর জেনারেল সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর সাথে একান্তে কথা বললেন। তিনি ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সম্পর্কে অনেক জেনেছেন ব্ংলাদেশী শান্তিরক্ষী অফিসারদের কাছ থেকে। তিনি স্বপ্ন দেখেন দুদেশের সম্পর্ক আরো গভীর করার।

আমরা বিমানবন্দর থেকে যাই এয়ার হাউজে। দোতলা ছোট একটি বাড়ী । ভাড়া বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ লাখ টাকা। ঢাকার তুলনায় কিছু বেশীই মনে হলো। ৬ মে আমরা গেলাম বামাকোয় অবস্থিত লামিতি হোটেলে। এটি এখন জাতিসংঘ মিশনের সদর দপ্তর। এখানে আমরা সাক্ষাৎ করলাম ফোর্সূ কমান্ডার মেজর জেনারেল মাইকেল ললেস গার্ডের সাথে। তিনি ডেনমার্কের অধিবাসী। তাছাড়া সাক্ষাৎ করলাম মেজর জেনারেল সালাহউদ্দিন মিয়াজীর নেতৃত্বে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারী জেনারেল ও মালিতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি মংগী হামদির সঙ্গে। তারা সবাই বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের প্রশংসা করলেন। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের শৃংখলা, দায়িত্বশীলতা, কর্তব্য পালনে আন্তরিকতা, সাহসিকতা এবং সর্বোপরি পেশাদায়িত্বের প্রশংসা করলেন তারা। এসময় বাংলাদেশী শুভেচ্ছা দলটি চীফ অব স্টাফ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ক্রিশ্চিয়ান থিউভোল্ট-এর সাথেও সাক্ষাৎ করে।

৬মে বিকেলে আমরা বের হলাম বামাকো নগরী দেখতে। ছোট শহর। লোকসংখ্যা তেমন বেশী নয়। রাস্তায় গাড়ীর সংখ্যাও কম। একটি বিষয় চোখ পড়ার মত। তাহলো রাস্তায় মটর সাইকেল চালক ও আরোহী অনেকেই মহিলা। শতকরা অন্তত ৪০ ভাগ মটর সাইকেল চালক মহিলা। নাইজার নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে বামাকো নগরী। বামাকোর দুই অংশ দুইটি সেতু দ্বারা সংযুক্ত। সেতু সংলগ্ন পাঁচ তারকা হোটেল লিবিয়া হোটেল। লিবিয়ার প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফীর পতন ও মৃত্যুর পর এটি বন্ধ হয়ে যায়। নাইজার নদীর তীরে একটি অভিজাত ভবন বিশ্ব  সুন্দরী ও ভারতের খ্যাতিমান চিত্রনায়িকা ঐশ¡্যরিয়ার নামে-ঐশ¡্যরিয়া ভবন। সেতু পার হওয়ার সময় ভবনটি দেখা যায়। মালি ভ্রমনে এসে তিনি এ ভবনে ছিলেন বলেই এ ভবনের এরকম নামকরণ।

এদেশের সচিবালয় এলাকায় রয়েছে  সুরম্য সব বৃহৎ অট্রালিকা। এগুলো নির্মিত হয়েছে লিবিয়ার আর্থিক সহায়তায়। বৃহৎ সব হলুদ রঙের ভবনগুলো স্বাক্ষ্য হয়ে আছে একসময় লিবিয়ার সাথে এদেশের চমৎকার সম্পর্কের।

গাও এবং কিদাল ভ্রমণ ঃ

৭ মে ২০১৫ আমরা সকাল ৭টায় কিদালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। জাতিসংঘের বিমানে প্রথমে গাও সিটিতে অবতরণ করি। ১০ টায় আমরা গাও সিটিতে পৌছাই। বামাকো থেকে গাও সিটির দূরত্ব ১৩০০ কিলোমিটার । ৩ ঘন্টার বিমান ভ্রমণ। গাও বিভাগীয় শহর। লোক সংখ্যা ৫০ হাজার। এ সেক্টরে কাজ করছে মোট ৩৪০০ শান্তিরক্ষী। বাংলাদেশ ছাড়াও এখানে মোতায়েন রয়েছে নাইজার, সেনেগাল, আইভরিকোষ্ট, চীন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, চাঁদ ও বরকিনা ফসোর শান্তিরক্ষীরা। গাও সেক্টরে রয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ১৩৩ জন সদস্য। নাইজার নদী ৪২০০ কিঃমি র্দীঘ। এ নদীর অর্ধেক মালির ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। গাও থেকে তুমবুকতু ও অসংসঙ্গ পর্যন্ত নাইজার নদী পথের ৯০০ কিমি নৌ রুটের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব বাংলাদেশ নৌবাহিনীর  শান্তিরক্ষীদের। ২০১৪ সালের এপ্রিল মাসে এখানে নৌ সদস্যরা নিয়োজিত হয়। ২০১২ সাল থেকে বিদ্রোহীদের কারণে এ পথে নৌচলাচল বন্ধ ছিল।

নৌবাহিনীর শান্তিরক্ষীরা দায়িত্ব নেয়ার পর এ নৌপথে নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে এবং বাণিজ্যিক নৌচলাচল শুরু হয়েছে। এখানে নৌবাহিনী জাহাজ দর্শক নিয়োজিত আছে। তাছাড়া স্পীড বোট রয়েছে ৬টি। নৌ কন্টিনজেন্টের অধিনায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন ক্যাপ্টেন সৈয়দ হাসিবুর রহমান। তার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন ক্যাপ্টেন আনামুল হক (মে ২০১৫)। শুষ্ক মৌসুমে নাইজার নদীর নাব্যতা সংকটের কারণে ৪ মাস নৌবাহিনীর জাহাজ কাজ করতে পারে না। এসময় তাদের  অনেকটা বসে থাকতে হয়।  এসময় নৌবাহিনী শান্তিরক্ষীদের মানবিক সহায়তা কাজে লাগানো যায় কিনা সে বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা  হচ্ছে । এখানে নিয়োজিত নৌবাহিনীর চিকিৎসক স্থানীয় গরীব জনসাধারণকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। স্কুল কলেজে খেলাধুলা সামগ্রী হিসাবে ফুটবল ও অন্যান্য উপকরণ দিচ্ছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নাইজার নদীতে নৌকাডুবি হয়। এসময় উদ্ধার কাজে অংশ নেয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সদস্যরা। এ কাজে তাদের ভূমিকা ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

সিগনাল কন্টিনজেন্ট ও ব্যানব্যাট-২ঃ

গাও সেকটরে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সিগনাল কন্টিনজেন্টের ১০০ জন সদস্য। এখানে সেক্টর ইস্ট ও নর্থ এবং সেক্টর হেডকোয়ার্টার ও এর ইউনিট সমূহের মধ্যেকার যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা সিগনালস-এর মূল কাজ। এর মধ্যে রয়েছে Installation, Operation and maintenance  । সিগনাল কন্টিনজেন্ট সদস্যরা গাও শহরের সরকারী কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আইটি প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদেরকে দক্ষ মানব সম্পদ হিসাবে গড়ে তুলছেন। এরা রসদ ও মালামাল পরিবহনে প্রহরা ও বেসামরিক লোকদের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত¦ পালন করে থাকে। গাও সিটিতে সিগনাল কন্টিনজেন্টর অধিনায়কের দায়িতে¦ ছিলেন লে.কর্নেল আলাউল কবির । এখানে মোতায়েন রয়েছে ব্যানব্যাট-২ এর ৮৫০ সদস্যের একটি সেনা শান্তিরক্ষী দল। এদের মধ্যে ৬ জন চিকিৎসক। এর অধিনায়ক কর্নেল মীর মুশফিকুর রহমান। ব্যানব্যাট-২  কিদালে রসদ পৌছে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত যানবাহনের নিরাপত্তার দায়িত¦ পালন করে। বেসামরিক জনসাধারণের নিরাপত্তা ও গাও বিমান বন্দরের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্বও ব্যানব্যাট-২ এর শান্তিরক্ষীদের।

কিদালঃ

বামাকো থেকে কিদালের দূরত্ব ১৬০০ কিমি এবং গাও থেকে ৩০০ কিলোমিটার।ু কিদাল শহর মরুভূমি এলাকায় অবস্থিত।  এখানে ১৫ হাজার লোকের বাস। এখানকার তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সড়কপথে যোগযোগ দুর্গম। মরুময় ও পর্বত সংকুল পাহাড়ী টেরেইন দিয়ে যেতে হয় কিদালে। কিছুদিন পূর্বে কিদাল বিমান বন্দর দখলে নিয়েছিল বিদ্রোহীরা। এ সময় সংঘর্ষে বিমান বন্দর ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এজন্য বিমান অবতরণ করতে পারে না। আমরা জাতিসংঘ হেলিকপ্টারে করে দুপুরের দিকে কিদাল পৌছাই। এক/দেড় ঘন্টার দূরত্ব আকাশ পথে। কিদালে শান্তিরক্ষীদেরকে বিরূপ আবহাওয়ার মধ্যে দায়িত¦ পালন করতে হয়। তাছাড়া রয়েছে বিদ্রোহীদের হামলার আশংকা। কিদালের উত্তরাঞ্চল পুরোটা বিদ্রোহীদের দখলে। ৬ মে (২০১৫) কিদাল এলাকায় বিদ্রোহীরা ৮ বার রকেট হামলা করেছে বলে জানা যায়। ক্যাম্পের কাছাকাছি রকেট পড়েছে। তবে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। একটি বেসামরিক গাড়ী ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ হামলার ভয়ে অনেক দেশের প্রতিনিধিরা কিদাল সফর বাতিল করেছে। ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমাদের শুভেচ্ছা দলটি কিদাল সফরের সূচি অপরিবর্তিত রাখে এবং ৭ মে কিদাল সফরে যায়।

কিদালে পানি সংকট প্রকট এখানকার শান্তিরক্ষীদের জন্য দৈনিক পানি প্রায়োজন ৭৮ হাজার লিটার। সরবরাহ পাওয়া যায় ৩৫ হাজার লিটার। জনপ্রতি পানি পাওয়া যায় মাত্র ১০ লিটার । এ তথ্য দিয়েছেন কিদালে নিযুক্ত ডেপুটি কোর্স কমান্ডার কর্নেল মিশেল লেডান সেওর (ফ্রান্স)। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর শুভেচ্ছা দলটি কিদাল সফরে আসবে এজন্য সবাই কৃচ্ছতা সাধন করে আমাদের জন্য পানি সংরক্ষণ করেছে। কিদালে বিদ্যুৎ নেই। জেনারেটরের সাহায্যে বিদ্যুত উৎপাদন  করা হয়। কিদালে নিয়োজিত আছে  BANENGR (বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ার)  কন্টিনজেন্টের ১৪০ জন সদস্য। এদের মধ্যে ১৭ জন্য অফিসার। বাকিরা অন্যান্য পদবীর।  BANENGR এর অধিনায়ক লে.কর্ণেল মোস্তাফিজুর রহমান।

কিদালে রসদ সরবরাহ করা হয় বামাকো থেকে সড়কপথে। তবে এ পথকে সড়ক বলা যায় না। অধিকাংশ  Sandy rockey terrain  এখানে রয়েছে মাইন বিস্ফোরণের ভয় ও বিদ্রোহীদের হামলার আশংকা। বিদ্রোহীরা রাস্তায় চৌম্বক মাইন পূঁতে রাখে। চলন্ত গাড়ীতে মাইন নিক্ষেপ করে রিমোট কন্টোল দ্বারা বিস্ফোরন ঘটায়। তাছাড়া রয়েছে ধূলিঝড় ও অত্যধিক তাপমাত্রা। অত্যধিক তাপমাত্রায় অনেক সময় গাড়ীর চাকা ফেটে যায়।  মরুঝড়ের কবলে পড়ে গাড়ী বহরকে ৩/৪ দিন আটকে থাকতে হয়। রসদ পরিবহনে অনেক সময় লাগার কারণে মাছ, মাংস শাকসব্জি ইত্যাদী ৩০%-৪০% নষ্ট হয়ে যায়। কিদালে ব্যানএঞ্জার-এর প্রধান কাজ বাংকার-এর নিরাপত্তা বিধান, পানি সরবরাহ সড়কও রাস্তা নির্মাণ, রাস্তায় পেট্রলিং এবং ব্যানএয়ার কন্টিনজেন্টকে সহায়তা প্রদান। মর্টার হামলা থেকে রক্ষার জন্য এখানকার ক্যাম্পগুলো স্যান্ড ব্যাগ দিয়ে পরিবেষ্টিত। মর্টার হামলা থেকে কিছুটা নিরাপদ থাকা গেলেও এখানে রয়েছে প্রতিনিয়ত মরু ঝড়। মরু ঝড়ে ক্যাম্প তছনছ হয়ে যায়। পুনরায় ক্যাম্প নির্মাণ করতে হয়। এখানকার ক্যাম্প তৈরী করা হয়েছে কন্টেইনারকে সামান্য রূপান্তর করে।

কিদালে ব্যানএয়ার কন্টিনজেন্টঃ

২০১৪ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ  বিমান বাহিনী মালির কিদালে ১২৩ সদস্যের ব্যানএয়ার কন্টিজেন্ট প্রেরণ করে। এ কন্টিনজেন্ট দতার সাথে জাতিসংঘ ক্যাম্প ও দুই কিলোমিটার দূরবর্তী এয়ার ফিল্ডের দায়িত্বে নিয়োজিত আছে। এই ইউনিটটি এয়ার ট্রাফিক কন্টোল, ফ্লাইট ফলোইং সার্ভিস, র‌্যাম্প কন্ট্রোল, ফায়ার ফাইটিং, মেটিওরোলজি এবং মুভমেন্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করছে। প্রতিকূল আবহাওয়া, অতি উচ্চ তাপমাত্রা, ধূলি ও বালু ঝড় এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির মত কঠিন পরিস্থিতিতে দায়িত¦ পালন করছে। এছাড়া বিপর্যস্ত সড়ক ব্যবস্থা, পথিমধ্যে মাইন বিস্ফোরণ, রসদ সরবরাহে অসুবিধা ইত্যাদি প্রতিকুলতার মধ্যে কাজ করছে। এতদসত্ত্বেও ব্যানএয়ার কন্টিনজেন্ট দায়িত¦ পালনে দক্ষতা ও পেশাদারিত্বেও জন্য সকলের প্রশংসা পেয়েছে। সম্প্রতি মালিতে বিমান বাহিনীর তিনটি  এমআই-১৭১ হেলিকপ্টার মোতায়েন করা হয়েছে।

৮মে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে বুলেটপ্র“ফ জ্যাকেট পরে আমরা বাংকারে  চলে যাই। কেননা এসময়টাতেই দূর পাহাড় থেকে বিদ্রোহীরা শান্তিরক্ষীদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে মর্টার হামলা চালায়। এ হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য শান্তিরক্ষীরা প্রতিদিন বুলেটপ্র“ফ জ্যাকেট পরে সশস্ত্র পাহারা জোরদার করে। এক ঘন্টা এভাবে বাংকারে থাকার পর আমরা রুমে চলে আসি। ঐদিন  আমরা ফিরে আসি বামাকোতে। কিদাল থেকে জাতিসংঘ হেলিকপ্টারে গাও এবং গাও থেকে বিমানে বামাকো।

মালিতে ব্যানব্যাট-১ এর কয়েকটি সফল অভিযানঃ

৯মে বামাকোর ব্যানব্যাট ক্যাম্পে আমাদেরকে বাংলাদেশী  শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়। মালিতে ব্যানব্যাট – ১ এর চীফ অপারেশন্স অফিসার লে. কর্নেল কাজী মোহাম্মদ জাকারীয়া ব্যানব্যাটের নি¤েœর  কয়েকটি সফল অভিযানের কথা তুলে ধরেন ঃ

১।     লারনেব ব্যানব্যাটের অপারেশন এলাকা দিয়াবালি থেকে ৮০ কিঃমিঃ দূরে অবস্থিত। এক সময়  আরব  মুভমেন্ট অব আযোয়াদ (Arab Movement of Azawad)  – এর দুই গ্র“পের মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হয়। নিকটবর্তী বরকিনা ফসো ব্যাটালিয়নকে দুই গ্র“পের মাঝখানে অবস্থান নিতে বলা হয়। এবং যুদ্ধ বিরতি চুক্তি যাতে ভঙ্গ না হয় তা নিশ্চিত করতে আদেশ দেওয়া হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে,বরকিনা ফসো ব্যাটালিয়ন এ দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানায়। এসময় বাংলাদেশ ব্যাটালিয়নকে ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে এ দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেওয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন নির্দেশ পাওয়ার সাথে সাথে বিবদমান দুই গ্র“পের মাঝখানে  অবস্থান নেয় এবং বাফার হিসাবে সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে। ধৈর্য ও কৌশলী পদক্ষেপের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন দুই গ্র“পের সংঘর্ষ থামাতে সমর্থ হয় এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছাতে সক্ষম হয়। অপারেশনের ব্যাপ্তিকাল ছিল ৩৬ দিন। এ সাফল্য শুধু ব্যানব্যাটের নয় এটা ছিল মিনুসমার সাফল্য। এটা সর্বস্তরে প্রশংসিত হয়েছিল।

২।    একটি ব্যানব্যাট পেট্রোলকে এন্টি এবং প্রো আজওয়াদ গ্র“পের গতিবিধি এবং  উদ্দেশ্য সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে বলা হয়। তারা  তাবানকোর্ট নামক স্থানে অবস্থান করছিল। ব্যানব্যাট অবস্থান নেওয়ার সময় দুই গ্র“পের মধ্যে পুরোদমে গুলিবিনিময় চলছিল। পেট্রোলের দলনেতা  একগ্র“প হতে আর এক গ্র“পের কাছে গিয়ে গোলাগুলি বন্ধ করার আহবান জানায়। কিন্তু তারা গোলাগুলি অব্যাহত রাখে। কয়েকদিন ধরে এরকম গোলাগুলি চলে। আর দুই গ্র“পের মাঝখানে অবস্থান নেয় বাংলাদেশ ব্যাটালিয়ন। চার দিক থেকে গুলি বর্ষিত হচ্ছে। কিন্তু পেট্রোলের দলনেতা নিজেদেরকে প্রত্যাহার করে নিলেন না। তিনি জানতেন তাদের গুপকে এখান থেকে প্রত্যাহার করে নিলে গ্রামে ব্যাপক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়বে এবং বিপুল সংখ্যক বেসামরিক লোক হতাহত হবে। ফোর্সেস সদর দপ্তর পেট্রোলের দলনেতাকে সিন্ধান্ত নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এখান থেকে সরে আসলেন না জীবনের বিরাট ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও। শেষ পর্যন্ত সংঘর্ষ থেমে যায় এবং বেসামরিক লোকদের জীবন রক্ষা পায়। পুরো অভিযানে ব্যানব্যাট এর অসম সাহস, বীরত্ব ও অদম্য ইচ্ছা  শক্তির প্রকাশ ঘটে। পেট্রোলের দলনেতা ছিলেন মেজর সায়াদাত এবং পেট্রোল সদস্য ছিল ৫০ জন।

৩।    ব্যানব্যাট মালির উত্তরাঞ্চলে রসদ সামগ্রী পরিবহন যানকে নিরাপত্তা এসকট প্রদানের এক গুরুদায়িত্ব পালন করেছিল। একসময় পরিস্থিতিতির মারাত্মক অবনতি হলে সেক্টর নর্থ এসকট দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হয়ে পড়ে। কেননা তাদের এপিসির মত কমব্যাট বা প্রোটেকশন যানবাহন ছিলনা। এ অবস্থায় কোন বিকল্প উপায় না দেখে ব্যানব্যাট সদস্যদেরকে রশদবাহী যানবাহনকে প্রহরা দিয়ে দুর্গম পাহাড়ী এলাকা কিদালে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করেন।

এ পথের দূরত্ব ছিল ৪০০ কিলোমিটার যার মধো ১২০ কিঃমি সেক্টর নর্থ-এর অন্তর্ভূক্ত। যাত্রাপথটি ছিল মরুময় এবং পাহাড়ী এলাকা, রাস্তায় ছিল পুঁতে রাখা মাইন বিস্ফোরনের আশংকা, কোন পানির উৎস কিংবা নদী নালা ছিল না, ক্যাম্প স্থাপনের মত কোন জায়গা ছিল না। বিশেষ করে আনাফিজ থেকে কিদাল পর্যন্ত দীর্ঘ পথটি ছিল মাইন অধ্যূসিত এলাকা। এ অবস্থায় কোন মাইন রোলার ছাড়াই ব্যানব্যাট রসদযানের নিরাপত্তা বিধানের দায়িত্ব পালন করেছে। ফিরে আসার পথে ৫/৬ দিন সময় লাগার কথা থাকলেও বেসামরিক গাড়ীর ইঞ্জিনের পাহাড়ীপথে চলাচলে সমস্যার কারণে ৮/৯ দিন সময় লাগত। এভাবে এসকর্ট দায়িত্ব আরো কঠিনতর হয়ে পড়ে। বিপদসংকুল পাথরময় মরুপথে সহযোদ্ধা শান্তিরক্ষীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক দায়িত্বপালন করে। এটা ছিল অন্যের জন্য নিঃস্বার্থ সেবা এবং অন্যের জন্য নিজের জীবনকে ঝুঁকির মধ্যে নিপতিত করার বিরল  দৃষ্টান্ত।

৪।    ২০১৫ সালের ২৭ জানুয়ারী গাও শহরে আযোয়াদ বিরোধী এক ব্যাপক বিক্ষোভ হয় যার লক্ষ্যবস্তু ছিল মালির জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের স্থাপনা সমূহ। বিক্ষোভকারীরা একপর্যায়ে সহিংস হয়ে উঠে এবং শান্তিরক্ষা স্থাপনার উপর ইট পাটকেল ও ককটেল নিক্ষেপ করতে থাকে এবং শান্তিরক্ষীদের নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেঙ্গে ফেলার উপক্রম করে। গাও ক্যাম্পের ব্যানব্যাট সদস্যরা এ অবস্থায় শক্তি প্রয়োগ না করে বিকল্প পথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার চেষ্টা করলেন। শান্তিরক্ষীরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিলেন এবং কোন রকম উস্কানীমূলক জবাব দিলেন না।  শান্তিরক্ষীরা বরং আলোচনার পথে গেলেন এবং অপ্রাণঘাতি উপায় ব্যবহার করলেন (non-leathal means) এর ফলে এই বিক্ষোভ কোন রকম জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই নিরশন করা সম্ভব হয়। এধরনের পদক্ষেপ বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের অসাধারণ পেশাদারিত্ব বহন করে যা জাতিসংঘ প্রত্যাশা করে।

৫।    ১০ মার্চ ২০১৫ তারিখ রাত ৩টা ১০ মিনিটে ৩৪টি civilian logistic vehicles escort প্রদানকারী ব্যানব্যাট এসকট আলমোস্ট্যারাত থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে নাইট হল্টকালে ২০/২৫ জন দুস্কৃতিকারী কর্তৃক আক্রান্ত হয়। তারা স্বয়ংক্রীয় অস্ত্র, মর্টার ও IED ব্যবহার করছিল মিনুসমা কনভয়ের ক্ষতিসাধনের জন্য । ব্যানব্যাট সদস্যরা আক্রমনকারীদের কার্যকর ভাবে প্রতিহত করেছিল তাদের প্রতিরক্ষা পুন:বিন্যাস করে এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ গোলাবর্ষণের মাধ্যমে। একপর্যায়ে ৫ জন আক্রমনকারী ক্রলিং করে ক্যাম্পের দিকে আসতে থাকে এ সময় ব্যানব্যাট শান্তিরক্ষীরা গোলবর্ষণ করে এবং তাদেরেকে ফিরে যেতে বাধ্য করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বেসামরিক যানের কাছে মাইন স্থাপন করা অথবা বিস্ফোরক স্থাপন করা। ব্যানব্যাটের দক্ষতার কারণে বেসামরিক যান ও বেসামরিক ব্যক্তিবর্গের কোন ক্ষতিসাধন তারা করতে পারেনি। encounter  -এর সময় ব্যানব্যাটের প্রতিটি সদস্য অসম সাহস, পেশাদায়িত¦ ও আন্তরিকতার সাথে দায়িত্ব পালন করে বেসামরিক কনভয়কে বড় ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।

মালিতে সাফল্যজনক ভূমিকা এবং কর্মদক্ষতার জন্য ব্যানব্যাট-১ জাতিসংঘ কর্তৃক প্রিমিয়াম এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ইতিহাসে বাংলাদেশই প্রথম এই মর্যাদাপূর্ণ  পুরস্কার পেল। ব্যানব্যাটের ৮৫০ সদস্যের প্রত্যেকে এ পদক পাচ্ছে।

বাংলাদেশ ট্রাম্পপোর্ট কোম্পানী (BAN TPT), বামাকোঃ

মালির রাজধানী বামাকোতে নিয়োজিত রয়েছে বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর ১২০ জন সদস্য। এখানে আরো সাতটি দেশের শান্তিরক্ষী নিয়োজিত আছে। দেশগুলো হলো- ডেনমার্ক, হল্যান্ড, সুইডেন, নরওয়ে, ঘানা , নাইজেরিয়া ও মিশর। বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানীর প্রধান কাজ হচ্ছে বামাকো থেকে কিদালে মোতায়েন শান্তিরক্ষীদের জন্য প্রয়োজনীয় রসদ সামগ্রী পৌঁছে দেওয়া। একাজটি তারা নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও দক্ষতার সাথে পালন করে যাচ্ছে।  মরুভূমির দুর্গম rocky terrain দিয়ে ১৬০০ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে তারা রসদ সামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছে কিদালে। পথিমধ্যে রয়েছে বিদ্রোহীদের হামলার আশংকা,রয়েছে মাইন আক্রমনের মুখোমুখী হওয়ার আশংকা। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে মরুঝড় ও বালুঝড় প্রায়ই আঘাত হানে গাড়ী বহরকে। এসময় গাড়ীগুলো থামিয়ে ২/৩ দিন পর্যন্ত বসে থাকতে হয়। অত্যাতিক তাপমাত্রার কারণে গাড়ীর চাকা বসে যায়। মাইন ডিটেক্টর না থাকায় মাইনের অবস্থান নির্নয় করে নিরাপদ পথে চলার সুযোগও নেই।

সহযোগিতার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে বাংলাদেশঃ

মালিতে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা জাতিসংঘ কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষীদের সহায়তায় এগিয়ে আসার অনন্য নজির স্থাপন করেছে। বামাকোর এক ক্যাম্পে ৯মে আমাদের কথা হয় এখানে নিয়োজিত মিশরীয় সেনা কর্মকর্তা কর্ণেল হামদি এল গামালের সাথে। এখানে তিনি কোম্পানী কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। নিয়োজিত হওয়ার প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কাছ থেকে তিনি যে সহায়তা পেয়েছে তিনি তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বিশেষ করে মালিতে নিয়োজিত বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানী-১ এর ডেপুটি কন্টিনজেন্ট কমান্ডার মেজর এস এম হাবিব ইবনে জাহান-এর কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। তিনি অনর্গল বলে যাচ্ছেন- আমরা যখন এখানে আসি তখন প্রথমে দেখা হয় মেজর হাবিবের সাথে । তিনি আমাদের রেশন সামগ্রী দিয়েছেন, খাবার পানি দিয়েছেন। থাকার ক্যাম্প নির্মাণ করে দিয়েছেন বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা, ৬/৭ মাস ধরে মিশরীয় মিলিটারী পুলিশ এখানে নিয়োজিত রয়েছে। তিনি বলেন, “বাংলাদেশীরা খুবই অতিথি পরায়ণ, আন্তরিক, সহযোগী মনোভাবাপন্ন। They are very appreciative and  helpfull. বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীরা আমার ভাই-এটা আমি আমার হৃদয় থেকে বলছি। একদিন আমাদের খাবার ছিলনা, পানি ছিলনা, জ¦ালানী ছিলনা। এসবই আমার পেয়েছি আমার বাংলাদেশী ভাইদের কাছ থেকে।”

বামাকোয় নিয়োজিত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী চিকিৎসকরা নিজ দেশের শান্তিরক্ষীদের চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি অন্যদেশের শান্তিরক্ষীদেরও চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। বিদেশী শান্তিরক্ষীদের এ ব্যাপারে বাংলাদেশী চিকিৎসকদের উপর নির্ভরতা ও আস্থা সত্যি অবাক করার মত। সবাই আসছে বাংলাদেশ ক্যাম্পে এবং আস্থার সাথে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিচ্ছেন,ঔষধ নিচ্ছেন। বাংলাদেশী চিকিৎসকদের দক্ষতা, নিষ্ঠা ও পেশাদারিত্ব সকলের প্রশংসা অর্জন করছে। বাংলাদেশর চিকিৎসক মেজর মিজানুর রহমান ৯মে তার ক্যাম্পের চেম্বারে বলেন,  বাংলাদেশী চিকিৎসকরা স্থানীয় গরীব জনসাধারণকেও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন । গত এক বছরে ১৪০০ জনকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। গবাদি পশু মালিয়ানদের একটি মূল্যবান সম্পদ। তারা বাংলাদেশী পশু ডাক্তারদের কাছ থেকে বিনামূল্যে গবাদি পশুর চিকিৎসাও পাচ্ছেন এবং লাভবান হচ্ছেন। এজন্য তারা বাংলাদেশী চিকিৎসকদের কাছে ঋনী। মেজর মিজানুর রহমান আরো বলেন, আসিফো, ঘানা এভিয়েশন, নাইজেরিয়ান সিগনালস, ইন্দোনেশীয় এমপি থেকে আমাদের এখানে চিকিৎসা নিতে আসে। আমরা তাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি। সামরিক রোগীদের পাশাপাশি আমরা বেসামরিক রোগীদেরও চিকিৎসা দেই। তাছাড়া এমার্জেন্সি কন্ডিশনে আসা যেকোন রোগীকে আমরা চিকিৎসা সেবা দেই।

বাংলাদেশ ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসা নরওয়ে সেনাবাহিনীর মেজর জুলসরাব বলেন, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিকিৎসা অন্যান্য দেশের চেয়ে অনেক ভালো । এজন্য শুধু আমার দেশ নয় অন্যান্য দেশের শান্তিরক্ষীরাও বাংলাদেশ ক্যাম্পে চিকিৎসা নিতে আসে।

মালিতে নিয়োজিত পুলিশ কন্টেনজেন্টঃ

৯মে সন্ধ্যায় আমরা যাই বামাকোতে অবস্থিত বাংলাদেশ পুলিশ কন্টিনজেন্ট ক্যাম্পে। এখানে স­াইড প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে পুলিশের কর্মকান্ড সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়।

বিশে^র ৮টি দেশের শান্তিরক্ষী মিশনে প্রায় ১৩০০ পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছে ( মে ২০১৫)। এর মধ্যো মালিতে ১৪৪ জন, হাইতিতে ১৫৫ জন, কঙ্গোতে ১২৫ জন, দারফুরে ২৮০ জন, আইভরি কোষ্টে ১৮০ জন, দক্ষিণ  সুদানে এবং সোমালিয়ায় নিয়োজিত রয়েছে ৫০০ জন পুলিশ সদস্য।
বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা মালিয়ান পুলিশের প্রশিক্ষণ প্রদান, ভিভিআইপি/ভিআইপি ও জনসভার নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে।  সেদেশের ইবোলা প্রতিরোধে কাজ করেছে  বাংলাদেশ পুলিশ সদস্যরা। এভাবে তারা দেশের জন্য বয়ে এনেছে সম্মান ও গৌরব। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে ধারাবাহিক সাফল্য ও দক্ষতার কারণে প্রতিবছর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ পুলিশের চাহিদা বেড়েই চলেছে।

নৃতাত্ত্বিক যাদুঘর পরিদর্শন ঃ

১০  মে (২০১৫) আমরা যাই বামাকোতে  অবস্থিত ওদের নৃতাত্তিক যাদুঘর দেখতে। মালিয়ান জাতির উদ্ভব ও বিকাশের ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে এ যাদুঘরে। এখানে রয়েছে গ্রাগৈতিহাসিক ও প্রাচীন মালিয়ান সভ্যতার নিদর্শন। এখানে সাহারা সভ্যতারও নিদর্শন রয়েছে। এ থেকে ধারনা করা যায়, সাহারা মরুভূমিতে একসময় মানববসতি ছিল এবং মানবসভ্যতার বিকাশ হয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মরুভূমি সাহারার বিস্তৃীর্ণ অঞ্চল মালির অন্তর্ভুক্ত। এখানে রয়েছে এদেশের বস্ত্র শিল্প বিকাশের নিদর্শন। মালি বস্ত্র শিল্পে সমৃদ্ধ। তুলা উৎপাদনে মালি আফ্রিকায় তৃতীয়। জাদুঘর দেখার পর আমরা যাই জাতীয় উদ্যানে। এখানে অনেকে এসেছে পরিবার নিয়ে-খাবার দাবারসহ। চাদর বিছিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। খাবার খাচ্ছে। তরুণ-তরুণীরা আড্ডা দিচ্ছে, খেলাধুলা করছে। কোন রক্ষশীলতা চোখে পড়ছে না। হাটতে হাটতে আমি আর আপেল মাহমুদ দুই তরুনের সাথে কথা বলি। ওদেরকে নিমন্ত্রণ করি বাংলাদেশে ভ্রমণে আসতে। মালিতে বাংলাদেশের দূতাবাস নেই। কি করে বাংলাদেশে যাবে ওদের প্রশ্ন। আমরা বলি মরক্কোয় বাংলাদেশের দূতাবাস আছে। সেখান থেকে যাওয়া যেতে পারে। এর মধ্যে আমরা আমাদের মূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। অনেক খোঁজাখোজি করেও মূল দলকে না পেয়ে গাড়িতে গিয়ে অপেক্ষা করি। কিছুক্ষণ পর আমাদের খুজঁতে গাড়ির কাছে একজনকে পাঠানো হলো। তার সাথে আমরা গেলাম বালাসকো রেষ্টুরেন্টে, নৈশ ভোজে। জাতীয় উদ্যানের পাশেই এ রেষ্টুরেন্ট। সংসদ সদস্য মামাদো এনফা সিমপারা বাংলাদেশ শুভেচ্ছা দলের সম্মানে এ নৈশ ভোজের আয়োজন করেছেন। সম্পূর্ণ মালিয়ান খাবার। আমাদের অনেকেরই শংকা কেমন না কেমন খাবার। অনেক খাবার দেওয়া হলো। তবে কেউই হয়তো তৃপ্তি সহকারে খেতে পারেননি। এটা ওদের দেশের অভিজাত রেষ্টুরেন্ট। আন্তরিকতাও ছিল চমৎকার।

বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে সাক্ষাৎঃ

১১ মে তারিখে মেজর জেনারেল সালাহ উদ্দিন মিয়াজীর নেতৃত্বে শুভেচ্ছা দলটি সৌজন্য সাক্ষাৎ করে মালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং এনজিও ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট মুসা মারার সাথে। এরপর আমাদের দলনেতা সাক্ষাৎ করেন মালি সেনাবাহিনী প্রধান মেজর জেনারেল মাহামারে তুরে-এর সাথে। এরপর আমরা সাক্ষাৎ করি মালির কৃষিমন্ত্রী বোকারি তেরিটা ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী তিয়েনান হুবার্ট কুলিবালির সাথে। বাংলাদেশী  শান্তিরক্ষীদের ভূমিকার প্রশংসা করলেন তারা সবাই। বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের অনেক স্বপ্ন, অনেক প্রত্যাশা। তাদের দেশের বিস্তীর্ণ উর্বর ভূমি অনাবাদী পড়ে আছে। তাদের দরকার কৃষি  শ্রৃমিক, কৃষি প্রযুক্তি। আমাদের দেশের কৃষির উন্নতিতে তারা উচ্ছ্বসিত। তারা কৃষি ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। বিস্তীর্ন কৃষি জমি লীজ নিয়ে বাংলাদেশের কৃষি শ্রমিকরা আবাদ করতে পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাপক হারে কৃষি শ্রমিক প্রেরণ করতে পারে। এ ব্যাপারে তারা বাংলাদেশ সরকারকে চিঠি দিযেছে। তারা এখানে অনারারী কনসাল খুলতে আগ্রহী। মরক্কোয় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্টদূত মান্যবর মোঃ মনিরুল ইসলাম ১২-১৬ ফেবুয়ারি ২০১৫ মালি সফর করেন। তিনি মালিতে অনারারীকনসাল খোলার সুপারিশ করেন। মালির স্বাস্থ্য খাত খুবই পশ্চাৎপদ। তাছাড়া ঔষধের উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অপ্রতুল হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে মালিতে ঔষধ রফতানীর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। মালির কৃষকরা কৃষি জ্ঞানের অভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশ কৃষিবিদ ও কৃষিশ্রমিক পাঠিয়ে মালির কৃষি উন্নয়নে যেমন অবদান রাখতে পারে তেমনি জনশক্তি রফতানিরও সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে।

সংসদ সদস্য সিমপারা (১১ মে, ২০১৫) আমাদের শুভেচ্ছা দলের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজের আয়োজন  করেন চাইনিজ রেষ্টুরেন্টে। এবার অসাধারণ সব মজাদার খাবার । সবাই তৃপ্তি সহকারে খেয়েছে। ছিল  প্রক্রিয়াজাত ডাবের পানি। দেখতে দুধের মত। সংসদ সদস্য সিমপারা ভালবাসেন বাংলাদেশকে, বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের। এজন্য বাংলাদেশ শুভেচ্ছা দলকে এত সম্মান, এত আদর আপ্যায়ন।

কী করে আপন হলো এমপি সিমপারা ঃ

মালিতে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ ট্রান্সপোর্ট কোম্পানী-১ এর ডেপুটি কন্টিনজেন্ট কমান্ডার মেজর এসএম হাবিব ইবনে জাহান, এএসসি। তিনি পশ্চিম আফ্রিকার দেশ মালিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে সর্বশেষ দলের সাথে ১৩ মে ২০১৪ তারিখে  মালির রাজধানী বামাকোতে আসেন। মেজর হাবিব অপারেশনাল দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি এদেশের বেসামরিক দুস্থ জনগণের সহায়তায় এগিয়ে আসেন। সামরিক -বেসামরিক সহায়তা কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ২০১৪ সালের ২৬-২৭ জুন এবং ১৩ অক্টোবর মালির রাজধানী বামাকোতে গরীর ও দুস্থ অসহায় জনসাধারণের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা সহায়তা দেওয়া হয়। এই Free medical campaign  এর প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেন মেজর হাবিব ইবনে জাহান। এসময় মালির বেহাল স্বাস্থ্য খাত, ঔষধের উচ্চমূল্য ও দুস্থ জনগণের করুন অবস্থা তাকে ব্যথিত করে। অথচ এদেশে রয়েছে বিস্তীর্ন অনাবাদি কৃষি জমি। আমাদের মতই এদেশের জনগণের প্রধান খাদ্য ভাত। প্রধান পেশা কৃষি ও মৎস্য আহরণ। বিস্তীর্ন উর্বর জমি থাকা সত্ত্বেও এরা কৃষিক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। খুব স্বাভাবিক ভাবেই এদেশে কৃষি শ্রমিক প্রেরণ করা যায়। তাছাড়া ঔষধ রফতানি করেও বাংলাদেশ এদেশ থেকে ব্যাপক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। কিন্তু মালির সাথে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকায় এসব কিছু করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

মালিতে শান্তি রক্ষার দায়িত্বের পাশাপাশি মেজর হাবিব ইবনে জাহান উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে স্থানীয় এক তরুনের সহায়তায় সেদেশের এক প্রভাবশালী এমপি মামাদো সিমপারার সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। উদ্দেশ্য মালির সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা। মেজর হাবিব দু’দেশের কার্যকর সম্পর্ক স্থাপনের ফলে উভয় দেশে যে উপকৃত হতে পারে সে বিষয়টি তুলে ধরনে। তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে জেনে চমৎকৃত হন এবং বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রাহান্বিত হন। তিনি বিষয়টি সেদেশের সরকারের নিকট উপস্থাপন করেন এবং মালি সরকার বাংলাদেশের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহ প্রকাশ করে।

২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে সেনাসদর ওভারসীজ পরিদপ্তরের পরিচালক মালিতে মোতায়েনকৃত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের কার্যক্রম পরিদর্শনে যান। এসময় এমপি সিমপারার সহায়তায় সেদেশের সেনাবাহিনী প্রধান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরিচালক মহোদয়ের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। মালির সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাথে প্রশিক্ষণ সহযোগিতার ক্ষেত্রে কাজ করার আগ্রহ ব্যক্ত করেন। মালির প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশী নাগরিকদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজী করণ ও সেদেশে অনারারী কনসুলেট স্থাপন ও দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশে একটি উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিনিধি দল প্রেরণের ব্যাপারে আশ্বাস দেন।

দু’দেশের সম্ভাবনাময় সম্পর্কের সোপান রচনায় মেজর হাবিব ইবনে জাহান অনন্য সাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। মেজর হাবিব শান্তিরক্ষার সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব পালনের বাইরে গিয়ে দু’দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ কিভাবে লাভবান হতে পারে সেবিষয়ে সামরিক কূটনীতিকের ভূমিকা পালন করেন।

মোবাইল : ০১৭৬৯০১৭১৯৬

E- mail : nihabib@gmail.com

সম্পর্কিত পোস্ট